শুক্রবার । ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ । ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

তারেক রহমানের সতর্কবার্তা : ফেব্রুয়ারির ভোট বিএনপির পরীক্ষা নাকি টার্নিং পয়েন্ট?

নিয়াজ মাহমুদ

নির্বাচনী ট্রেনে দেশ। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির ভোট ও গণভোটকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে উত্তাপ দ্রুত বাড়ছে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৯ ডিসেম্বর—এই সময়সীমাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর সমীকরণ, কৌশল ও প্রার্থী বাছাই নিয়ে নীরব প্রতিযোগিতা এখন তুঙ্গে। ঠিক এমন সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য নির্বাচনী পরিবেশে নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে।

ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, “আগামী নির্বাচন যা ভাবছেন তা নয়।”

প্রায় এক বছর আগে দেওয়া তাঁর সেই সতর্কবাণী পরিস্থিতি যত এগোচ্ছে, ততই বাস্তবসম্মত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

তারেক রহমানের বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক সভার ভাষণ নয়; বরং আসন্ন নির্বাচনের জটিলতা ও অনিশ্চয়তার দিকেও স্পষ্ট ইঙ্গিত। বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর বক্তব্য বিএনপির অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রভাব—সবকিছু মিলিয়ে দলের সামনে কঠিন পরীক্ষার বার্তা দেয়।

বিএনপির সামনে তিন দিকের চ্যালেঞ্জ : তারেক রহমান স্পষ্টই স্বীকার করেন—বিএনপি শুধু একক সংকটে নেই; বরং কাঠামোগত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তিনদিকে বড় ধরনের চাপের মুখে। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দলটিকে আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের টিকে থাকার লড়াই চালাতে হয়েছে। গ্রেফতার, মামলা, নেতাকর্মীর ছত্রভঙ্গ—এসবই বিএনপির দৈনন্দিন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। তাঁর মতে, যদি দল এখনো “সিরিয়াস” না হয়, তবে দেশের সার্বভৌমত্ব পর্যন্ত হুমকির মুখে পড়তে পারে।

যদিও এই বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে কঠোর, তবে এর ভেতরে একটি কৌশলগত দিক রয়েছে। তিনি মূলত দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিচ্ছেন—রাজপথ, গণমত ও নির্বাচনী মেসেজ—এই তিনটির সঠিক সমন্বয় করতে না পারলে ব্যালটের লড়াই জেতা কঠিন হবে।

নীতিনির্ভর রাজনৈতিক বার্তা ও সংগঠনের সক্রিয়তা: অনুষ্ঠানে তারেক রহমান বলেন, বিএনপির পরিকল্পনাগুলো মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিতে হবে। তাঁর এই বক্তব্যে দুটি বিষয় বিশেষভাবে উঠে আসে—

১. সংগঠনকে আবারো মাঠে সক্রিয় করা ২. নীতিনির্ভর রাজনীতিকে সামনে আনা।

দলটি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে তারা ক্ষমতায় এলে দলীয়করণ কমিয়ে বহুমাত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়তে চায়। কিন্তু এখনো সাধারণ ভোটারদের কাছে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা স্পষ্ট নয়। এ কারণেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন খাতে কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে বিএনপি এবার নীতিগত পরিকল্পনা সামনে আনার চেষ্টা করছে। দলের কৌশলবিদদের মতে, এই উদ্যোগগুলো ভোটারদের আস্থা অর্জনে ভূমিকা রাখবে।

দলীয় সরকার নয়—তারেক রহমানের ঘোষণা: তারেক রহমান বলেন, “বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দলীয় সরকার হবে না।” অতীতে দলীয় প্রভাব ও পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে বিএনপি অসংখ্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। তাই নির্বাচনী বছরে এমন ঘোষণা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এখন প্রশ্ন—এই বার্তা কতটা জনমনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে? এর উত্তর নির্ভর করবে দলের মাঠের আচরণ ও বাস্তব পদক্ষেপের ওপর।

একইসঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন—অন্যান্য রাজনৈতিক দল মিথ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে, অথচ বিএনপি সেই পথে যাবে না। তিনি জোর দেন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার ওপর। রাজনৈতিক যোগাযোগ কৌশলের অংশ হিসেবেই তিনি সত্য-মিথ্যার বিভ্রান্তিময় পরিবেশে বিএনপির জন্য একটি ‘ক্রেডিবল ন্যারেটিভ’ তৈরি করতে চান।

ধর্মীয় স্থানে বক্তব্য—বিতর্ক ও প্রতিপক্ষের সমালোচনা: মসজিদে বক্তব্য দেওয়ার প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, “কেউ যদি বলতে পারে, আপনি কেন পারবেন না? বললে সবার বলার অধিকার আছে।” তাঁর এ মন্তব্য নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে। ধর্মীয় স্থানে রাজনৈতিক বক্তব্য যে বিতর্কিত—সে সত্য অস্বীকার করা যাবে না। তবে একইসঙ্গে তিনি যে নীতি উল্লেখ করেছেন—সবার জন্য নিয়ম এক—তা গণতন্ত্রের মূল চরিত্র।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধর্মীয় মঞ্চ ব্যবহার নতুন নয়। বিভিন্ন দল বছরের পর বছর এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে। তাই বিএনপি এমন জায়গায় নিজেদের পিছিয়ে রাখতে চায়নি বলেই বিশ্লেষকদের মত।

মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল ঠেকাতে বার্তা : তারেক রহমান বলেন, “প্রার্থী আসবে, প্রার্থী পরিবর্তন হবে, তবে দল ও আদর্শ রয়ে যাবে।” এই বক্তব্য মূলত অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার সংকেত। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে টানাপোড়েন এ সময়ে স্বাভাবিক। তাই তিনি আগেভাগেই জানিয়ে দিচ্ছেন—ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আদর্শ বড়; ব্যক্তিপূজার জায়গা নেই।

আগামী নির্বাচনে বিএনপির মধ্যে প্রার্থী বাছাই নিয়ে টানাপোড়েন বাড়বে—এটা প্রায় নিশ্চিত। সেই প্রেক্ষাপটে তাঁর আগাম বার্তা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

জামায়াতের একই ধরনের সুর : কয়েক সপ্তাহ আগে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানও একই ধরনের ভাষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন—দীর্ঘদিন ‘চাষাবাদের’ পর ‘ফসল তোলার সময় এসেছে’। আন্দোলনের কর্মীদের সর্বোচ্চ ত্যাগ নিয়ে মাঠে থাকতে হবে। তাঁদের মতে, নির্বাচনের এই মুহূর্ত দেশ ও জাতির টার্নিং পয়েন্ট।

দুই দলের এই সুর প্রমাণ করে—অসন্তুষ্ট ও বিরোধী শিবিরের রাজনীতিতে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এখন এক গুরুত্বপূর্ণ থ্রেশহোল্ড।

কঠিন ও অনিশ্চিত পথের ইঙ্গিত : সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন ঝঞ্ঝাপূর্ণ। নির্বাচনের পথ মসৃণ মনে হলেও মাঠের বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল—প্রশাসনিক প্রভাব, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের শক্তি, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও জনমতের দোলাচল—সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি কঠিন লড়াই।

তারেক রহমান যে অ্যালার্ম দিয়েছেন—তা স্পষ্টতই দলের জন্য সতর্কবার্তা। এখনো যদি প্রস্তুতি না নেওয়া হয়, তবে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাঁর বক্তব্যে গণতন্ত্র, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের প্রত্যাশার কথা থাকলেও মূল বার্তা ছিল একটাই—এখনই কাজের সময়।

আগামী কয়েক সপ্তাহেই এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য যেমন সুযোগ, তেমনি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জও। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংগঠন কতটা প্রস্তুত—তা-ই হয়তো নির্ধারণ করে দেবে ফেব্রুয়ারির ভোট আসলেই তাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হবে কিনা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

email: niazjournalist@gmail.com

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন